উপন্যাস——দুরে কেন? মনের দুয়ারে এসো—–উপন্যাস
দ্বিতীয় খন্ড
কলমে- এস এম মারুফ বিল্লাহ্
সময় ও সাগরের ঢেউ কখনো কারো অপেক্ষামান নয়। বাতাসের মতো চারদিকে মুহুর্ত্বের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো আজকের এই প্রাণহীন দেহটির কথা। এই মহল্লার নীতিবান যে কখনো ন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি, সত্যের জয় গান যার মুখে ছিল সব সময়। যিনি সারাটি জীবন খেটে গেছেন অসহায় দুখি এতিম মানুষের বন্ধু হয়ে। সেই মহৎ মানুষ জামান সাহেবের প্রাণ আর এই মহল্লায় নেই। খাঁচার ভেতর আটকা পড়া পাখি যেমন একবার দরজা খোলা পেলেই ফুঁড়ুৎ করে উড়ে যায়, আর ফিরে আসেনা সেই খাঁচায়। ঠিক তেমনি এই মহল্লায় প্রাণপ্রিয় মানুষ জামান সাহেবের প্রাণ পাখিটি ওই আটকা পড়া পাখিটির মতো বিধাতার দরজা খুলা পেয়েই চলে গেছে, আসবেনা ফিরে আর কখনো জামান সাহেবের ছোট্ট বুকের খাঁচায়। ফিরবেনা আর এই মহল্লায়। জামান সাহেবের মৃত্যুতে এই মহল্লায় শোকের ছায়া নেমে এলো। সবুজ গাছ-গাছালিতে একেবারে থমথমে ভাব। মহল্লাবাসির কান্নায় ভারি হয়ে উঠল সমস্ত আকাশ, বাতাস, পৃথিবীর চারদিক।
সুদ্বীপ্তর মায়ের জ্ঞান ফিরে এলো। প্রাণপ্রিয় স্বামীর অষাড় দেহটাকে জড়িয়ে পাগিলিনীর মতো কাঁদতে লাগলেন। যেভাবে কাঁদে প্রিয়জন পৃথিবী তেখে শেষ বিদায় নেবার সময়। কাঁদতে কাঁদতে বললেন- ওরে তোরা আমার বড় মেয়ে শ্রাবন্তীকে খবর দে।
তীর্ণ বললো- ভাইয়া ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। ওরা প্রায় আসার মতো হয়ে গেছে। বলতে না বলতেই কাতর কন্ঠে আম্মু..আম্মু চিৎকার দিতে দিতে শ্রাবন্তী ঘরে প্রবেশ করে মমতাময়ী মাকে জড়িয়ে বাবাকে হারানোর কান্নায় ভেঙে পড়লো।
এক এক আত্মীয় স্বজন জামান সাহেবের শেষ মুখটা দেখে শেষ বিদায় জানাতে গত দিনের হাসি খুঁশি আর আজকের প্রানহীন জামান সাহেবের নীড়ে।
জামান সাহেবের বরই পাতা মেশানো গরম জলে শেষ গোসল দিয়ে সাড়ে তিন হাত কবর নামের বিদায়ের শেষ জামা- সাদা কাপড়ে আতর মিশিয়ে জড়িয়ে খাঁটিয়ান নামের শেষ খাটে উঠালেন। বিদায়ের শেষ সীমানায় পোঁছে দেবার জন্য। তারপর পবিত্র মুখখানি সাদা কাপড়ের শেষ অংশটি দিয়ে ঢেকে দিলেন। খাঁটিয়ান কাঁধে উঠালেন কাছের মানুষগুলো। সামনের সারির একধারে সুদ্বীপ্ত। বাবার অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েও তাকে ধরে রাখার ক্ষমতা নেই সুদ্বীপ্তর। মন চাইছে না বাবাকে ঘর ছেড়ে বাহিরে নিয়ে যেতে। মন না চাইলেও করার কিছু নেই। কারণ এটাই যে বিধাতার বেঁধে দেওয়া নিয়ম। মায়ার বাঁধন ছেড়ে এভাবে সবাইকে একদিন শেষ বিদায় জানিয়ে চলে যেতে হবে আঁধারে ঢাকা না ফেরার দেশে। সেই নিয়মে বাঁধা পড়েছে আজ সুদ্বীপ্ত নিজেই। বাবার এতো ভালোবাসা পেয়েও আজ বাবাকে পৃথিবী থেকে শেষ বিদায় দিতে খাঁটিয়ানের এক ধার কাঁধে উঠালো সুদ্বীপ্ত নিজেই। বাবাকে শেষ বিদায় দেবার কথা মনে আসতেই মনে এসে যাচ্ছে অতিতে বাবাকে নিয়ে হাসি আনন্দের সমস্ত চিত্রগুলো। ভেঙে যাচ্ছে সমস্ত বুকটা। যেন বুকটা ৭১-এর যুদ্ধের ঝাঁঝাঁলো বারুদের মতো ঝাঁঝরা হতে লাগলো। বাবা শেষ নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেছেন তবুও তার সমস্ত দেহটা এখনো পৃথিবীতে আছে। এতে অনেকটা শান্তনা মিশে আছে। কিন্তু একটু পরে বাবাকে যখন বাঁশের ব্যাড়া দেওয়া ছোট্ট ঘরে চিরদিনের জন্য রেখে আসব, পাশে দাঁড়িয়ে হাজারো বার বাবা বাবা করে ডাকলেও কোন সাড়া দেবে না। তখন কেমন করে আমি নিজেকে বুঝাব! মা-বোনকে বোঝাব! যেন এ ভাবনার শেষ নেই। তবুও শত কষ্টকে উপেক্ষা করে বাবাকে গহীন মাটির বুকে শেষ বিদায় দিয়ে দু’চোখের ফোঁটা ফোঁটা বিন্দু বিন্দু অশ্রু মুছতে মুছতে ফিরে এলো আজকের শ্মশানের মতো স্তব্ধময় কান্নায় ভারি হওয়া নিজ বাড়িটিতে। যে বাড়ির আঙিনায় সর্বক্ষণ আনন্দমূখর, আনন্দধারা আনন্দে আনন্দে মুখরিত হতো, আজ সে বাড়ির ভিতর মনোমুগ্ধকর স্বচ্ছ পরিবেশ একটি প্রাণ হারিয়ে হয়েছে ভয়াবহ সিডর। সিডর যেমন আঘাত হেনে মানুষের মাঝে আতঙ্কের দানা বেঁধে সব কিছু উলাট পালট করে দেয়। কিছুদিন এমন আকার ধারণ করে রাখে যে, সেখানে শুধু স্তব্ধতার আবির্ভার ঘটে একান্ত নিজেস্ব ভাবে। ঠিক তেমনি আজ স্তব্ধতা বয়ে যাচ্ছে সুদ্বীপ্তর উপর।
সময় ফুরিয়ে এলে সবাইকে যেতে হয়- কবর, কফিন কিংবা চিতার অনলে। এভাবেই পৃথিবীর মায়া জাল থেকে সবাইকে একে একে বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে বিদায় নিতে হয় এই দু’দিনের মায়া খেলার দুনিয়ার বুক থেকে। ঠিক তেমনি সুদ্বীপ্তর বাবা জনাব জামান সাহেবও চলে গেলেন বিধাতার বেঁধে দেওয়া নিয়মে। বিধাতার বেঁধে দেওয়া নিয়মে জামান সাহেব পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে অজানা পথে হারিয়ে গেলেন আজ প্রায় আট মাস গত হলো। এ ক’দিন বাবাকে হারানোর কষ্ট ছাড়া এ সংসারে আর্থিক অনটন দেখা দেয়নি। বাবার আদর্শ নীতির কারনে অর্থের ভান্ডার রেখে গেছেন খুবই সীমিত। কিন্তু এই অর্থ সীমিত হলেও ছিল একজন সততাবান মানুষের কস্টের সৎ উপার্জিত খাঁটি ফসল। এই ফসল একটু একটু করে এই আট মাস কেটেছে ভালো ভাবেই। কিন্তু বাকি সময় দিন, মাস, বছরগুলো কাটবে কিভাবে? তা নিয়ে সুদ্বীপ্ত প্রতিদিনই ভাবে। বাবা এই ধরণী থেকে বিদায় নেবার পর যেন সুদ্বীপ্তর চিন্তার ধারা বেড়েই চলেছে। এই সীমাহীন চিন্তার যেন শেস নেই।
সুদ্বীপ্ত যে শুধুই ভেবে দিন পার করছে তা কিন্তু ঠিক নয়। সে লেখা পড়ার ফাঁকে কোন একটা কাজের সন্ধানে ঘুরছে। কিন্তু ভাগ্য যেন তাকে কোন কাজের সন্ধান দিতে চাইছে না। এদিকে সোনার সংসারে নেমে এলো অর্থহীন জীবনের অভাবের ঠোঁকর। এ ঠোঁকর থেকে মা-বোন আর নিজেকে বাঁচাতে প্রয়োজন অর্থের। কিন্তু আজ তার পকেট প্রায় শূন্য। মানি ব্যাগের ভিতর এক গুপ্ত জায়গায় আছে নতুন একটা পঞ্চাশ টাকার দু’ভাঁজ করা নোট। যা বাবার শেষ আর্শিবাদ হিসেবে রেখে দিয়েছে সুদ্বীপ্ত। অন্য দিনের মতো আজও সুদ্বীপ্ত কলেজ শেষে বেরিয়েছে চাকুরি নামের সোনার কাঠির সন্ধানে।
দোরে দোরে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যাধারা নেমে এলো এ পৃথিবীর প্রতিটি আঙিনায়। না! আজও একটি চাকুরির সন্ধান মিললো না। দেশে এতো মিল-কারখানা, ফ্যাক্টরী, আফিস-আদালত থাকতে আজো কোথাও একটা পরিবারকে নিয়ে বেঁচে থাকার মতো চাকরি জুটলো না সুদ্বীপ্তর ভাগ্যে। পৃথিবীর সব কিছু যখন ভাগ্য বিধাতার নিয়মে চলে তবে কেন সেই ভাগ্য বিধাতা সুদ্বীপ্তর জীবনে একটা চাকুরির সন্ধান মিলিয়ে দিতে ব্যর্থ।
এখানেই শেষ নয়। ধারাবাহিক ভাবে পেতে চোখ রাখুন “সমাজের চোখ” নিউজ পোর্টালে।