রাসেল সরকার: বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়েছে। ‘সড়ক পরিবহনে সংগঠন পরিচালনা ব্যয়’ সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রণয়ন করে এই চাঁদাবাজিকে বৈধতাও দেওয়া হয়েছে।
সড়কে চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠনিক রূপ দেওয়ার অভিযোগ আছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খানের বিরুদ্ধে, তার সহযোগী ছিলেন তৎকালীন আসমানী পরিবহনের আহবায়ক রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা রফিক ও বাপ্পি রুবেল হিরো। বর্তমানে শাজাহান খান গ্রেপ্তার হলেও তার সহযোগী রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা রফিক, রুবেল, বাপ্পি, হিরো’র নেতৃত্বে এখনো আসমানী পরিবহন মালিকদের জিম্মি করে চাঁদা উত্তোলন করছে বলে বিশেষ সূত্রে জানা যায় এবং ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৪৯ শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়েছে। এর একটি বড় অংশ নিয়মিত গেছে শাজাহান খানের পকেটে। ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে পরিবহন মালিক সমিতির অপর প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সড়ক থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন তিনি।
শাজাহান খান বাহিনীর প্রধান রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা রফিক, রুবেল, বাপ্পি ও হিরো’র কাছে বছরের পর বছর জিম্মি ছিলেন পরিবহন মালিকরা। পরিবহন মালিকদের সূত্রে জানা যায় শাজাহান খান গ্রেপ্তার হলেও তার বাহিনীর প্রধান রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা রফিক রুবেল বাপ্পি হিরো এখন পরিবহন মালিকদের জিম্বি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিগত সময়ে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দিলেই বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের যান চলাচল। এর নেপথ্যেও ছিলেন এই শাজাহান খান ও তার বাহিনীর প্রধান রফিকুল ইসলাম গ্রুপে কালা রফিক ও রুবেল বাপ্পি হিরো। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের অন্যতম বাধাও ছিলেন তিনি।
নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ সময়ে তার আয় বেড়েছে প্রায় ৩২ গুণ।
পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, সড়ক পরিবহন আইনে রাস্তা থেকে চাঁদা তোলার কোনো বিধান নেই। এরপরও পরিবহন খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজির নেতৃত্বে ছিলেন শাজাহান খান। বিভিন্ন টার্মিনাল, উপজেলা পর্যায়ে চাঁদা তুলে পাঁচ ভাগের এক ভাগ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে গেছে। এই ফেডারেশনের সবকিছুই চলেছে শাজাহান খানের ইশারায়। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিবহন সেক্টরে ১২ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন শাজাহান খানের লোকজন।
তিনি আরও বলেন, শাজাহান খান ও সহযোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবহনে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। চাঁদাবাজির আয়ে পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজনের নামে তারা বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সম্পদ করেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের আবেদন, অনতিবিলম্বে তদন্ত করে এসব অবৈধ সম্পত্তি জব্দ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হোক।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই পরিবহন খাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবহন খাতে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তার। ২০০৯ সাল থেকে সড়কে বিক্ষিপ্ত আকারে নানা অঙ্কের চাঁদা তোলা হতো।
করোনাকালে কিছু দিন গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। পরে ২০২০ সালের ১ জুন থেকে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানে ২০২০ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট এই ৩ মাস সড়কে চাঁদা তোলা বন্ধ ছিল। এ সময় চাঁদা তোলার নতুন ফন্দি আঁটা হয়। প্রণয়ন করা হয় সড়ক পরিবহন সংগঠন পরিচালনা ব্যয় বা সার্ভিস চার্জসংক্রান্ত নির্দেশিকা। এ নির্দেশিকা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি।
নির্দেশিকার ৪১টি ধারায় সড়কে চাঁদাবাজিকে দেওয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। নির্দেশিকায় ঢাকা মহানগর এলাকা ও শহরতলিতে কে কোথায় চাঁদা তুলবে, আন্তঃজেলায় চলা যানবাহনে ঢাকার কোন স্পটে কারা চাঁদা তুলবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর চাঁদা তোলার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে নির্দেশিকায়। নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রতিদিন একটি বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে একবার ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলার কথা। কিন্তু বাস্তবে একদিনে ১৫ থেকে ২০ বারও চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব যানবাহনকে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহনের সংখ্যা ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫৩টি। এসব যানবাহন থেকে দিনে একবার করে ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হলেও এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকা। এ হিসাবে নির্দেশিকা প্রণয়নের পর ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত শুধু বিআরটিএর নিবন্ধিত বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে ৬ হাজার ৯৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ৬৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, ২০০৯ সালের পর থেকে শাজাহান খানের নামে পরিবহন খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু হয়। টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থানে পরিবহনের লোকের বাইরে তার (শাজাহান খান) লোকেরা রাজনৈতিক প্রভাবে চাঁদাবাজি করেছেন।
তিনি বলেন, বাস মালিকদের নানাভাবে জিম্মি করে রাখতেন শাজাহান খান। তার জন্য সড়কে চাঁদাবাজি কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নি। কিছু অসাধু বাস মালিক নেতার সঙ্গে আঁতাত করে পরিবহন খাতকে নাজেহাল করেছেন তিনি। অনেক মালিক তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনকে তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন।
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় তিনি আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ তার আয় বেড়ে প্রায় ৩২ গুণ হয়েছে। ২০০৮ সালে শাজাহান খানের অস্থাবর সম্পদ ছিল প্রায় ৫৭ লাখ টাকার। এখন তা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় (আসবাব, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ও বন্দুকের দাম বাদে)। অর্থাৎ তার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে পাঁচগুণ। মাদারীপুর-২ আসন থেকে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন শাজাহান খান। একই আসন থেকে তিনি পরের নির্বাচনগুলোতেও প্রার্থী হন।
শাজাহানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ফুড ভিলেজ (সার্বিক হোটেল) সবকিছুই তার পরিবারের সদস্যদের নামে। বিশেষ করে ঢাকা-মাদারীপুর রুটের সার্বিক পরিবহন কোম্পানিতে একক আধিপত্য তার। এ পরিবহনের ব্যানারে ২০০টির বেশি গাড়ি চলাচল করত। এ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করেছিলেন তার ছেলেকে।
অনেকেই বলেন পরিবহন শ্রমিকদের গডফাদার শাজাহান খান। অভিযোগ রয়েছে, সারা দেশে শ্রমিকদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এই শ্রমিক নেতা।
বিগত সময়ে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দিলেই বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের যান চলাচল। এসব পরিবহন ধর্মঘটের জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করে বিএনপি। ওই সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, তাদের সমাবেশগুলোতে ব্যাপক লোকসমাগম হচ্ছে, আর এই লোকসমাগম ঠেকাতে সরকার গণপরিবহনকেও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
সূত্র জানায়, মূলত সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে কখনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই, আবার কখনো নানা অজুহাতে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে গণপরিবহন চলাচল বন্ধের নেপথ্যে ছিলেন শাজাহান খান। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে আসতে পারেননি অনেক নেতাকর্মী। এতে সাধারণ মানুষও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। অনেকে দেশের বাইরে থেকে এসে বিমানবন্দরে আটকে গেছেন। চিকিৎসার জন্য অনেকে দূর-দূরান্তে যেতে পারেননি। তবে সরকারের বাহবা পেয়েছেন শাজাহান খান। সরকারের কাছ থেকে বাগিয়ে নিয়েছেন সুযোগ-সুবিধা।
২০১৮ সালে ঢাকায় বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় সড়ক পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচিত হন। শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নামে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনার জেরে ছাত্র-জনতার নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনেরও সমালোচনা করেছেন শাজাহান খান।
সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের অন্যতম বাধা ছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, এই শ্রমিক নেতার ঘোর বিরোধিতার কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট নৌ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেওয়া দরকার। কারণ তারা সিগন্যাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চেনে। সুতরাং তাদের লাইসেন্স দেওয়া যায়। তার এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হলে সর্বমহলে তীব্র সমালোচনা হয়।