এম রাসেল সরকার: গণপরিবহন খাত ত্রিপক্ষীয় সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দুর্নীতিবিরোধী কোনো কার্যক্রম সফল হবে না। যুগের পর যুগ পরিবহন সেক্টরের অনাচার, বিশৃঙ্খলা ও চাঁদাবাজি দেখতে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে নগরবাসী। ১৯৮৪ সাল থেকে এই পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনগুলো সরকার দলীয় চাঁদাবাজদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। তাদের অত্যাচার পুরাতন মালিক শ্রমিক কেউই এখনো ভুলতে পারেন নাই।
গত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও সড়কে বিশৃঙ্খলা করে লুটপাট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। সে হিসাব এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিবহন সেক্টর শাজাহান খান, এনায়েত উল্যাহ ওসমান আলীর আধিপত্য চলতো। এখন তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। শাজাহান খান ইতোমধ্যেই গ্রেফতার হয়ে রয়েছেন জেলখানায়। খন্দকার এনায়েত উল্যাহ রয়েছেন বিদেশে ও ওসমান আলীসহ পরিবহন খাতের অনেক নেতা রয়েছেন দেশের ভিতরেই আত্মগোপনে। এরই মধ্যে পরিবহন খাতকে চাঁদামুক্ত ও সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় বিআরটিএ ও সরকারের কতিপয় সংস্থাকে সাথে নিয়ে কাজ করেছে বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। কিন্তু কতিপয় গণপরিবহনের মালিক নামধারী কিছু ব্যক্তি নতুন কৌশলে পরিবহন খাতকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা।
তারা জানিয়েছেন, ফেনীর মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ৩০ বছর আগে পরিবহন ব্যবসা করতেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ফেনীর একরাম হত্যা মামলা। তিনি একরাম হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি। ওবায়দুল কাদেরসহ আ.লীগের অনেকের সাথে ছিলো তার সখ্যতা। সোহরাব হোসেন তিনি আগের সরকারের আমলে পরিবহন মালিক সমিতির নেতা ছিলেন। শাজাহান খানের ভাগনে মামুন, মহারাজ, স্বপনসহ কিছু ব্যক্তি ঢাকা পরিবহন সেক্টরকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আপচেষ্টা করছে এমনটাই জানালেন পরিবহন নেতারা।
পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। সরকারের বাসভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ছিল শাজাহান খানের। সরকারনির্ধারিত ভাড়া না মানলেও পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত না সরকার। আবার পণ্য পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায়েও শাজাহান খানদের ইন্ধন ছিল। তাদের কথাই ছিল সড়কে আইন। গত সরকার সড়ক আইন প্রণয়ন করলেও শাজাহান খানদের চাপে আইনের ধারা শিথিল করে। শাজাহান খানের ইশারাতেই কথায় কথায় যান চলাচল বন্ধ রেখে মানুষের ভোগান্তিকে জিম্মি করে দাবি আদায় করত পরিবহন কর্মীরা। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে পরিবহন সেক্টরে ১২ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজির নামে লুট করেছে শাজাহান খানের লোকজন।
এক কথায় শাজাহান খান ছিলেন পরিবহন খাতের মাফিয়া ডন। পরিবহন খাতে অন্যায়ভাবে চাঁদাবাজিকে বৈধতা দিয়েছিলেন শাজাহান খান-ওসমান আলী গ্রুপ। গত ১৬ বছরে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় শাজাহান খান ছাড়াও ছিলেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠনিক রূপ দেওয়ার অভিযোগ আছে তাদের বিরদ্ধে।
এদিকে আওয়ামীপন্থী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নামে এক পক্ষের ডাকা সংবাদ সম্মেলন জাতীয় প্রেসক্লাবে করতে চাইলে প্রতিপক্ষের লোকজন ও সাধারণ বাস মালিকদের পক্ষ থেকে লোকজন এসে সংবাদ সম্মেলন বন্ধ করে দেয়। সংবাদ সম্মেলন করতে না পেরে আয়োজক বিকাশ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম সৌরভ হোসেন ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির শতাধিক লোক হঠাৎ প্রেসক্লাবে এসে হামলা চালিয়ে সংবাদ সম্মেলন প- করে দেয়। কতিপয় মালিক আলাদা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রেক্ষিতে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে কমিটি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, পরিবহন খাতকে চাঁদামুক্ত ও সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় বিআরটিএ ও সরকারের কতিপয় সংস্থাকে সাথে নিয়ে আমরা কাজ করছি। কিন্তু কতিপয় গণপরিবহনের মালিক নামধারী কিছু ব্যক্তি নতুন কৌশলে পরিবহন খাতকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। বাস মালিকদের নানাভাবে জিম্মি করে রাখতেন অনেক নেতা। তখন সড়কে চাঁদাবাজি কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নি। কিছু অসাধু বাস মালিক নেতার সঙ্গে আঁতাত করে পরিবহন খাতকে নাজেহাল করেছেন। অনেক মালিক তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল। আমরা চাঁদাবাজি ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছি।
হাসিনা সরকারের দেড় দশকের শাসনামলের মধ্যে ১৪ বছরে শুধু সড়ক ও মহাসড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজে ২৯ হাজার থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে ধারণা পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
দেশের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ঠিকাদারের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমের নীতিনির্ধারণ, সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এই দুর্নীতি করেছে। জনস্বার্থে নেওয়া প্রকল্পগুলোতে নিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি করায় এসব দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে ঘুষ লেনদেনে ২৩-৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়। ত্রিপক্ষীয় ‘সিন্ডিকেট’ (চক্র) ভাঙতে না পারলে দুর্নীতিবিরোধী কোনো কার্যক্রম সফল হবে না।
সাইফুল ইসলামের কমিটি মানতে নারাজ শাজাহান খানের গুরুপ:
গত ৫ই আগষ্ট ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি সহ সারা বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যকর অবস্থার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন নির্যাতন, নিপীড়নের ফলশ্রুতিতে কোটা আন্দোলনের হাত ধরে ছাত্র-জনতা সর্বস্তরের জনগন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফার মধ্য দিয়ে স্বৈর শাসক শেখ হাসিনার যেমন পতন হয়েছে একই সময়ে পরিবহন সেক্টরে দীর্ঘদিনের মালিকদের স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকান্ডে যারা নেতৃত্বে সরাসরি জড়িত ছিল তারা পরিবহন সেক্টর গরিত্যাক্ত রেখে দেশের বাহিরে পালিয়ে যায় এবং বাকিরা আত্মগোপনে রয়েছে। পালিয়ে যাওয়া নেতৃত্ব ঢাকা সড়কের গঠনতন্ত্র পরিপন্থি ও নিয়ম বহির্ভূত বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন অবস্থায় মালিকদের ব্যবসা সংরক্ষন ও যাত্রী সাধারনের নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সুশৃংখল ও সচল রাখার স্বার্থে ঢাকা সড়কের সাধারন মালিক ও কাউন্সিলরবৃন্দ গঠনতন্ত্র মোতাবেক গত ১৪/৮/২০২৪ইং তারিখে তলবী সভা আহবান করা হয়।
এতে সাধারন মালিকগনের উপস্থিতিতে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সদস্য সচিব মো: সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে আসমানী পরিবহন লিমিটেড আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়, এতে আসমানী পরিবহনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনকে আহবায়ক ও মো: নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া কে সদস্য সচিব করা হয়। নবনির্বাচিত আহবায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দদের এবং সাধারণ পরিবহন মালিকদের কে শারীরিক নির্যাতন মানসিক নির্যাতন সহ তাদের গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই কমিটি মানতে নারাজ কুখ্যাত পরিবহন চাঁদাবাজ শাজাহান খানের প্রধান রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা (রফিক), রুবেল, বাপ্পি, মনোয়ার, হিরো।
বিশেষ সূত্রে জানা যায় রফিকুল ইসলাম ওরফে (রফিক) স্বৈরাচার হাসিনার শাসনামলে শাজাহান খানের নির্দেশে সড়ক ও পরিবহন সেক্টর থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদা উত্তোলন করতেন। শাজাহান খান গ্রেপ্তার হলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে শাজাহান খানের প্রধান হাতিয়ার কালা রফিক সহ তার অনুসারীরা। সাধারণ মালিকদের অভিযোগ এখনো প্রতিটা পরিবহন থেকে রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা (রফিক) রুবেল বাপ্পি মনোয়ার ও হিরো কে চাঁদা না দিলে তাদের গাড়ি রাস্তায় চলতে দেওয়া হয় না। এবং বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি দিয়ে তাদেরকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধ গাড়ির মালিক অভিযোগ করে বলেন স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার আমলে শাজাহান খান ও খন্দকার এনায়েত উল্যাহ'র প্রভাব বিস্তার করে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করতেন এই কালা রফিক। প্রথমে পরিবহন সেক্টরে একটি গাড়ি নিয়ে সে প্রবেশ করে আজ তার ১৪টা গাড়ি কিভাবে হল।
সাধারণ পরিবহন মালিকরা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, শাজাহান খান ও খন্দকার এনায়েত উল্যাহ'র গৃহপালিত শীর্ষ সন্ত্রাসী রফিকুল ইসলাম ওরফে কালা (রফিক) রুবেল বাপ্পি মনোয়ার হিরো'র সম্পদের পরিমাণ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত করে দ্রুত গ্রেফতার করার জোর দাবি জানান। চলবে.!!